টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
টাইগার মুরগি (Tiger Chicken) পালন করার পদ্ধতি অন্যান্য মুরগি পালনের মতো হলেও কিছু নির্দিষ্ট যত্ন ও ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এই জাতটি সাধারণত দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এর মাংসের মানও ভালো, যা বাজারে ভালো দাম পায়। টাইগার মুরগি পালন করতে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করা যায়:টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
আরো পরুন : ধান কাটার মেশিন কোথায় পাওয়া যাবে
১. বাচ্ছা সংগ্রহ
- ভালো মানের টাইগার মুরগির বাচ্ছা সংগ্রহ করা গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় খামার বা পরিচিত প্রজনন কেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যকর বাচ্ছা কিনুন।
- চবাচ্ছ্বর য়স ১ দিনের মধ্যেই হতে হবে এবং সুস্থ ও প্রাণবন্ত বাচ্ছা নিতে হবে।
২. খাঁচা ও আশ্রয়
- টাইগার মুরগি পালনের জন্য মুরগির খাঁচা বা ঘরের ব্যবস্থা করতে হবে।
- ঘরটি হওয়া উচিত রোদ, বৃষ্টি এবং ঠান্ডা থেকে সুরক্ষিত।
- বায়ু চলাচলের ভালো ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং পর্যাপ্ত জায়গা রাখতে হবে যাতে মুরগিরা সহজে চলাচল করতে পারে।
৩. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
- টাইগার মুরগির চারাগুলো প্রথম ২-৩ সপ্তাহ বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। এই সময়ে ৩২-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রাখা উচিত।
- ধীরে ধীরে তাপমাত্রা কমিয়ে আনুন এবং ৪-৫ সপ্তাহ পরে তাদের বাইরে বা সাধারণ তাপমাত্রায় রাখা যায়।টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
আরো পরুন : আমন ধান চাষ পদ্ধতি
৪. খাদ্য সরবরাহ
- টাইগার মুরগিকে বিশেষ খাদ্য সরবরাহ করতে হবে যা তাদের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়ক।
- চারা মুরগিদের জন্য উচ্চ মানের স্টার্টার ফিড (protein rich) ব্যবহার করতে পারেন। ৩ সপ্তাহ পরে গ্রোয়ার ফিড এবং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ফিনিশার ফিড দিন।টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
- পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পানির পাত্র সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে।
৫. টিকা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা
- নিয়মিত টিকা দেওয়া জরুরি, যাতে মুরগিরা রোগমুক্ত থাকে। নিউক্যাসল, গামবোরো এবং ফাউল পক্সের মত রোগের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়া উচিত।টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
- নিয়মিতভাবে মুরগিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে এবং যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয় তবে দ্রুত পশু চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৬. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা
- মুরগির বাসস্থান পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মল ও অন্যান্য বর্জ্য প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে।
- খাঁচা এবং খাবার ও পানির পাত্র পরিষ্কার করা জরুরি।
৭. বাজারজাতকরণ
- টাইগার মুরগিরা সাধারণত ৮-১২ সপ্তাহের মধ্যে বাজারজাত করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।
- মুরগির ওজন ও মাংসের মান অনুযায়ী স্থানীয় বাজারে বা পাইকারি ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
টাইগার মুরগি কত দিনে ডিম পাড়ে
টাইগার মুরগি সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক হতে ৫-৬ মাস সময় নেয়, এবং এই সময়ের পরেই তারা ডিম পাড়া শুরু করতে পারে। তবে, ডিম পাড়ার সময় এবং পরিমাণ নির্ভর করে মুরগির যত্ন, খাদ্য এবং পরিবেশের উপর। সাধারণত টাইগার মুরগি বছরে প্রায় ১৮০-২০০টি ডিম পাড়তে সক্ষম।টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
আরো পরুন : আলু চাষের পদ্ধতি । আলুর ফলন বৃদ্ধির উপায়
টাইগার মুরগি কি খায়
টাইগার মুরগি মূলত সাধারণ মুরগির মতোই খাদ্যগ্রহণ করে। এর খাদ্যতালিকায় সাধারণত শস্য, ছোট পোকামাকড়, শাকসবজি, এবং পাখির জন্য তৈরি করা বিভিন্ন বাণিজ্যিক খাবার অন্তর্ভুক্ত থাকে। কিছু বিশেষ ধরনের খাদ্য যেমন মুরগির পালকের গুণমান ও স্বাস্থ্য বৃদ্ধির জন্য দেওয়া হয়, যেমন ভুট্টা, গম, চালের কুঁড়া ইত্যাদি।টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
তাদের ভালোভাবে লালন-পালন করতে হলে পর্যাপ্ত প্রোটিন ও পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
টাইগার মুরগির ঔষধের তালিকা
টাইগার মুরগি (মোরগ বা মুরগির) বিভিন্ন রোগ থেকে বাঁচাতে এবং স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কিছু সাধারণ ওষুধ ব্যবহার করা হয়। তবে, মুরগির রোগ নির্ণয় এবং ওষুধের সঠিক প্রয়োগ একজন পশু চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করা উচিত। মুরগির জন্য যে ওষুধগুলো সাধারণত ব্যবহৃত হয়, তাদের তালিকা নিচে দেওয়া হলো:টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
১. এন্টিবায়োটিক (Antibiotics):
- টেট্রাসাইক্লিন (Tetracycline): শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের জন্য ব্যবহৃত।
- এমক্সিসিলিন (Amoxicillin): ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ দূর করতে ব্যবহৃত।
- এনরোফ্লক্সাসিন (Enrofloxacin): ফুসফুস, অন্ত্র, এবং ইউরিনারি সংক্রমণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
২. প্রতিজীবাণু ঔষধ (Antiprotozoal drugs):
- কোক্সিডিওস্ট্যাট (Coccidiostat): কোক্সিডিওসিস নামক অন্ত্রের পরজীবী সংক্রমণ রোধের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- সালফাকুইনক্সালিন (Sulfaquinoxaline): কোক্সিডিওসিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।
৩. অ্যান্টিপ্যারাসাইটিক (Antiparasitic):
- আইভারমেকটিন (Ivermectin): বাহ্যিক এবং অন্তর্নিহিত পরজীবী (যেমন: উকুন, মাইট, ওয়ার্ম) নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়।
- ফেনবেন্ডাজল (Fenbendazole): অন্ত্রের কৃমি দূর করতে ব্যবহৃত হয়।টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
৪. ভ্যাকসিন:
- এনডি ভ্যাকসিন (ND Vaccine): নিউক্যাসল রোগ প্রতিরোধের জন্য।
- আইবিডি ভ্যাকসিন (IBD Vaccine): গামবোরো রোগ প্রতিরোধের জন্য।
৫. ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট:
- ভিটামিন এ, ডি, ই সাপ্লিমেন্ট: মুরগির স্বাস্থ্য উন্নত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- মাল্টিভিটামিন: দেহের সঠিক বিকাশ ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য।
৬. প্রোবায়োটিকস ও ইলেক্ট্রোলাইট:
- প্রোবায়োটিকস (Probiotics): অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে ব্যবহৃত হয়।
- ইলেক্ট্রোলাইট পাউডার: ডিহাইড্রেশন প্রতিরোধে ব্যবহৃত।
এই ওষুধগুলো ব্যবহারের আগে একজন পশু চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করা উচিত, যাতে সঠিক ডোজ এবং ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায়।
টাইগার মুরগির খাবার তালিকা
টাইগার মুরগি বা অ্যাসিল জাতের মুরগির যত্নে সঠিক খাবার সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জাতের মুরগি সাধারণত মাংস ও লড়াইয়ের জন্য পালিত হয় এবং তাদের স্বাস্থ্য ও শক্তি বজায় রাখার জন্য বিশেষ ধরনের খাবার প্রয়োজন। টাইগার মুরগির খাবারের তালিকায় নিম্নলিখিত উপাদানগুলো থাকতে পারে:
১. প্রোটিনযুক্ত খাবার:
- মুরগির খাবার মিশ্রণ: পোল্ট্রি ফিডে সাধারণত প্রয়োজনীয় প্রোটিন থাকে।
- ডাল: ছোলা, মসুর ডাল, মটরশুটি ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ।
- মাছের মাংস: শুষ্ক মাছ বা কাটা মাছ।
- পোড়া কাটা মাংস: প্রোটিনের চাহিদা পূরণে সহায়ক।
২. শস্য ও শর্করা:
- ধান বা চালের কুড়া: ধান, গম বা চালের কুড়া মুরগির জন্য ভালো শর্করার উৎস।
- গম: শর্করা এবং শক্তি সরবরাহ করে।
- ভুট্টা: মুরগির খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৩. সবুজ শাক-সবজি:
- শাক-সবজি: পালং শাক, কচু শাক, কলমি শাক ইত্যাদি। এগুলো ভিটামিন ও খনিজ সরবরাহ করে।
- ঘাস: বিশেষ করে যেসব মুরগিকে বাইরে চারণভূমিতে রাখা হয়, তারা ঘাস খেতে পছন্দ করে।
৪. ক্যালসিয়াম ও খনিজ:
- ডিমের খোসা: ক্যালসিয়াম সরবরাহ করে।
- চুনাপাথর: শক্তিশালী হাড় এবং ডিমের খোসা তৈরিতে সহায়তা করে।
- মাটি বা বালি: কিছু পোল্ট্রি ফিডে বালি যোগ করা হয় যা হজমে সাহায্য করে।
৫. ভিটামিন ও মিনারেল:
- ভিটামিন ও মিনারেল সাপ্লিমেন্ট: বাজারে বিভিন্ন ধরনের পোল্ট্রি সাপ্লিমেন্ট পাওয়া যায় যা মুরগির স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
৬. পানি:
- তাজা পানি: সারাক্ষণ তাজা পানি দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। দিনে ২-৩ বার পানি পরিবর্তন করা উচিত।
খাবারের সময়সূচি:
- সকালবেলা প্রধান খাবার দিন।
- দুপুরে হালকা খাবার দিতে পারেন।
- সন্ধ্যায় আবার খাবার দিন।
টাইগার মুরগির জন্য এই খাদ্য তালিকা তাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং সর্বোচ্চ কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করতে সহায়ক।
টাইগার মুরগির ভ্যাকসিন তালিকা
টাইগার মুরগির ভ্যাকসিন বা সাধারণভাবে মুরগির জন্য ভ্যাকসিনের তালিকা নির্ভর করে বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধের জন্য দেওয়া হয়। টাইগার মুরগি বা ব্রয়লার মুরগির জন্য যে ভ্যাকসিনগুলো প্রয়োজনীয় তা নিচে দেওয়া হলো:
মুরগির সাধারণ ভ্যাকসিনের তালিকা:
- মারেকস ডিজিজ ভ্যাকসিন (Marek’s Disease Vaccine)
- প্রথম দিনেই বা একদিন বয়সে প্রয়োগ করতে হয়। এটি মুরগির ভাইরাসজনিত একটি মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ করে।
- নিউক্যাসল ডিজিজ ভ্যাকসিন (Newcastle Disease Vaccine – ND)
- ৭ দিন, ২১ দিন ও ৪০ দিন বয়সে দেওয়া হয়। এই রোগ মুরগির শ্বাসতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে।টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
- ইনফেকশাস ব্রঙ্কাইটিস (Infectious Bronchitis – IB) ভ্যাকসিন
- ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে প্রয়োগ করা হয়। এটি শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
- গামবোরো ডিজিজ ভ্যাকসিন (Infectious Bursal Disease – IBD or Gumboro)
- ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ও পরে ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এটি মুরগির ইমিউন সিস্টেমের ক্ষতি প্রতিরোধ করে।
- ফাউল পক্স ভ্যাকসিন (Fowl Pox Vaccine)
- ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ বয়সে প্রয়োগ করা হয়। এটি মুরগির ত্বকের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।টাইগার মুরগি পালন করার পদ্ধতি
- রানিক্ষেত (Ranikhet or ND)
- এটি ৭ দিন বয়সে ও ৩০ দিন বয়সে দেওয়া হয়, নিউক্যাসল রোগ প্রতিরোধের জন্য।
- এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন (Avian Influenza Vaccine)
- এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার আক্রমণ প্রতিরোধে এটি প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী প্রয়োগ করা হয়।
- এগ ড্রপ সিনড্রোম (Egg Drop Syndrome – EDS) ভ্যাকসিন
- ডিম পাড়া মুরগির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, যা ডিম উৎপাদন কমে যাওয়ার সমস্যা প্রতিরোধ করে।
ভ্যাকসিন প্রয়োগের সময়সূচী:
- ১ম দিন: মারেকস ডিজিজ।
- ৭ম দিন: নিউক্যাসল, ব্রঙ্কাইটিস।
- ১০ম দিন: গামবোরো।
- ১৪ম দিন: গামবোরো বুস্টার।
- ২১ম দিন: নিউক্যাসল বুস্টার।
এই ভ্যাকসিনগুলোর সঠিক প্রয়োগ এবং সময়সূচী মেনে চললে টাইগার বা ব্রয়লার মুরগি বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষিত থাকে।